Monthly Archives: October 2022

Malay Roychoudhury interviewed by Sajjal Datta

ব্যারাকপুর স্টেশন পত্রিকার  মুখোমুখি মলয় রায়চৌধুরী 

( ” বারাকপুর স্টেশন ” কবিতা পত্রিকার ৪র্থ সংখ্যায়   মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সজ্জ্বল দত্ত। সাক্ষাৎকার সহায়তা গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও রাজদীপ ভট্টাচার্য) 

সজ্জ্বল দত্ত: মলয়দা , বারাকপুর স্টেশন পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রথমেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আপনি এই সাক্ষাৎকারে সম্মত হয়েছেন এজন্য আমরা যারপরনাই উল্লসিত। শুরুতেই আপনার ছোটবেলার কথা, জন্ম, পারিপার্শ্বিক এবং বাল্যশিক্ষার বিষয়ে আমাদের যদি একটু জানান।

মলয় রায়চৌধুরী : প্রশ্ন পাঠাবার জন্য ধন্যবাদ । কিন্তু প্রশ্নগুলো পড়ে বুঝতে পারলুম যে তোমরা আমার বইপত্র পড়োনি, কেননা কোনো প্রশ্নই আমার কোনো বই পড়ে করা হয়নি । আমার বাল্যস্মৃতি ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ বইয়ের চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে । সাম্প্রতিক সংস্করণ প্রতিভাসের, নাম ‘ছোটোলোকের জীবন’ । আমি জন্মেছিলুম পাটনায় সরকারি হাসপাতালে ১৯৩৯ সালে । আমরা থাকতুম ইমলিতলা নামে একটা মহাদলিত আর গরিব শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা বস্তিতে । বাবা ছিলেন কুড়িজনের পরিবারের প্রধান রোজগেরে । পরে বড়োজেঠা পাটনা মিউজিয়ামে মূর্তি আর পেইনটিঙ ঝাড়পোঁছের ক্লাস ফোরের চাকরি পান । শিক্ষা পাটনাতেই, রামমোহন রায় সেমিনারি ব্রাহ্ম স্কুলে। সেখানকার গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তীর প্রভাবে মার্কসবাদে আকৃষ্ট হয়েছিলুম।

সজ্জ্বল :  বাংলা সাহিত্য ও কবিতার প্রতি আপনার ভাব-ভালোবাসার শুরুয়াত হল কীভাবে?

মলয় : আমার পড়াশোনা পাটনায় হলেও, দাদা সমীর রায়চৌধুরীর চরিত্র পাড়ার প্রভাবে খারাপ হয়ে যেতে পারে আঁচ করে ওনাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল । দাদা পাটনায় আসার সময়ে প্রচুর বাংলা বই আনতেন । আমি তিরিশের দশকের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হই । পাশাপাশি ইংরেজি কবিদেরও পড়া আরম্ভ করি, যাদের কবিতাপাঠ ম্যাকলে সাহেবের চাপে স্কুল আর কলেজের পাঠ্যে ঢুকেছিল । ১৯৫৯ নাগাদ বাবা একটা সুদৃশ্য ডায়েরি দিয়েছিলেন, তাতেই কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলুম ।

সজ্জ্বল :  আপনার দাদা আপনার সাহিত্যচর্চায় কতটা প্রভাবিত করেছেন আপনাকে?

মলয় : দাদা পশ্চিমবাংলার সাংস্কৃতিক প্রভাবে ভিন্ন চরিত্রের মানুষ ছিলেন । আমার বিপরীত । উনি ছিলেন সোফিসটিকেটেড । আমি মিশতুম পাটনার লুচ্চা-লাফাঙ্গাদের সঙ্গে। ইমলিতলায় ছোটোবেলাতেই শুয়োরের মাংস, ইঁদুর পোড়া আর তাড়ি খেয়ে ভিন্ন ধরণের জীবনে ইনিশিয়েশন হয়েছিল । ইমলিতলার বন্ধুরা আমাকে বেশি প্রভাবিত করেছিল । দোলখেলার সময়ে পাড়ার মহিলারা যৌনতার ইনহিবিশিন বাদ দিয়ে মেতে উঠতেন রঙ খেলায় । আমার প্রথম বন্ধুনি ছিলেন কুলসুম আপা নামের এক কিশোরী, যিনি আমার সঙ্গে গালিব আর ফয়েজ আহমদ ফয়েজের পরিচয় করান । ওনার সম্পর্কে মন খুলে লিখেছি বাল্যস্মৃতিতে । একজন যুবতীর যোনি উনিই প্রথম প্রত্যক্ষ আর অনুভব করতে দিয়েছিলেন।

সজ্জ্বল : হাংরি আন্দোলন বিষয়ে অবহিত নন যে পাঠক তাঁদের কথা ভেবে আপনাদের আন্দোলনের পশ্চাদপট এবং শুরুর দিনগুলির কথা সংক্ষেপে  একবার আমাদের জানান ।  

মলয় : হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে ৯৯% বাঙালি পাঠক অবহিত নন। পাঠক কেন, তরুণ কবি-সাহিত্যিকরাও জানেন না। অনেকে তো আমার নামই শোনেনি । তাই তাঁদের কথা আর ভাবি না । 

সজ্জ্বল : ক্ষুধার্ত মানে প্যাটের না চ্যাটের ক্ষুধা? আপনার সম্পূর্ণ সাহিত্যযাপন অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে অনুসরণ করলে এই প্রশ্ন কিন্তু বহুপাঠকের ভেতরে অবধারিতভাবে উঠে আসবেই  মলয় দা, আপনার কবিতা কি আদৌ বুভুক্ষুদের কথা বলে নাকি অহৈতুকী যৌনক্ষুধাকে গুরুত্ব দ্যায়?

মলয় : কী আর বলি ? আমার লেখাপত্র তো পড়ো না । পড়লে জানতে হাংরি শব্দটা কোথা থেকে পেয়েছিলুম । আর আন্দোলনের তাত্ত্বিক বনেদ কী ছিল । আমি ক্ষুধা শব্দটা ব্যবহার করিনি । চিরকাল হাংরি শব্দটাই ব্যবহার করেছি । ‘হাংরি’ শব্দটা প্রথমে পেয়েছিলুম কবি জিওফ্রে চসারের ‘In Swore Hungry Time’ বাক্যটি থেকে। আর আন্দোলনের তত্ত্ব গড়েছিলুম অসওয়াল্ড স্পেঙ্গলারের লেখা ‘The Decline of the West’ বইটি থেকে। স্পেঙ্গলারের এই তত্ত্বটির সারমর্ম হলো: 

“কোনো সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় ; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার উপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন।”

এই হাঙ্গার  শুধু আক্ষরিক অর্থেই হাঙ্গার ছিল না। তা ছিল সাহিত্যে মনের ভাব প্রকাশের হাঙ্গার, যথার্থ শব্দ প্রয়োগের, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষার হাঙ্গার। আমার মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। আমার মনে হয়েছিল যে কিছুটা হলেও এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দরকার, আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন। অর্থাৎ দেশভাগোত্তর বাঙালির কালখণ্ডটিকে আমি হাংরিরূপে চিহ্ণিত করতে চেয়েছিলুম। এখনকার পশ্চিমবাংলার দিকে তাকালে আমার বক্তব্যকে ভবিষ্যৎবাণী বলে মনে হবে ।

সজ্জ্বল :খুব সত্যি কথা , এ’ বিষয়ে আপনিও নিশ্চয়ই অবগত আছেন , হাংরি আন্দোলনের অনুসারীদের কেউ কেউ মনে করতেন যে আপনিই এই আন্দোলনকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছিলেন! আপনার কী বক্তব্য ? 

মলয় : আমি আর ছুরি মারব কেমন করে ? আমার বিরুদ্ধে মামলা চলেছিল ৩৫ মাস। বন্ধুরা বেশির ভাগ রাজসাক্ষী হয়ে আমার বিরুদ্ধে পুলিশে বয়ান দিয়েছিল আর কেটে পড়েছিল । সাক্ষী হবার জন্য আদালতের ট্রেজারি থেকে টাকাও পেয়েছিল । এইসমস্ত বন্ধুদের ঘৃণ্য মনে হয়েছিল। হাইকোর্টে মামলা জেতার পর ঘেন্নায় আমি এদের সংস্পর্শ ত্যাগ করে কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলুম । সৌভাগ্যবশত পাটনায়  রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ব্যাঙ্কনোট পোড়ানোর চাকরি ছেড়ে এআরডিসিতে গ্রামীণ উন্নয়ন আধিকারিকের চাকরি পেয়ে লখনউ চলে যাই । নতুন চাকরিতে যোগ দিয়ে টের পাই যে চাষবাস, পশুপালন, জলসেচ, গ্রামজীবন সম্পর্কে কিচ্ছু জানি না । এই সমস্ত বিষয়ে প্রচুর পড়াশুনা আরম্ভ করতে হয়েছিল । সাহিত্যের বই পড়া আপনা থেকেই পেছনে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছিলুম । তবে সরকারি চাকরি ছাড়ার ফলে এখন আমার পেনশন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পিওনের চেয়েও কম ।

সজ্জ্বল : রমানাথ রায় এবং শম্ভু রক্ষিতের কবিতা বিষয়ে আপনার কি মত?

মলয় : রমানাথ রায় তো কবিতা লিখতেন না ! শম্ভু রক্ষিত সম্পর্কে আমি বিস্তারিত লিখেছি। নেটে পাবে প্রবন্ধটা ।

সজ্জ্বল : কবিতা রচনায় বেশি মনোযোগ না দিলেও আসলে রমানাথ রায়ের কিছু ছোট্ট ছোট্ট চিত্রকল্পনির্ভর কবিতার কথা বলতে চেয়েছিলাম । যেমন – ‘ রাস্তায় রাস্তায় ‘ , ‘ চালের বদলে ‘ , ‘ আমার বুক ‘ ইত্যাদি । যাইহোক আপনার উত্তরে বুঝতে পারছি এগুলো আপনার কাছে খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি । থাক সে প্রসঙ্গ । রমানাথ রায়ের কথা যখন উঠলোই , এই অবসরে বরং আপনার কাছ থেকে একটু জেনে নেওয়া যাক হাংরি আন্দোলনেরই প্রায় সমসাময়িক রমানাথ রায়, সুব্রত সেনগুপ্ত, আশিস ঘোষ দের ‘ শাস্ত্রবিরোধী সাহিত্য আন্দোলন ‘  সম্পর্কে । হাংরি আন্দোলনের ঠিক পাশাপাশি এই আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মনোভাব কী ? আরো একটু নির্দিষ্ট বিন্দুতেই আসা যাক । ধরুন আপনার সম্পাদিত পত্রিকা ‘জেব্রা ‘র সঙ্গে সেইসময় শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের ‘ এই দশক ‘ এর দৃষ্টিভঙ্গী ও লেখা নির্বাচনে ঠিক কী ধরনের মিল-অমিল আপনি চিহ্নিত করবেন ?

মলয় : শাস্ত্রবিরোধিরা গল্প লেখায় প্রশংসনীয় কাজ করেছেন সেসময়ে । হাংরি আন্দোলনে কেবল সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্ত গল্প বা ফিকশানাল ন্যারেটিভ লিখতো । সুবিমল লিখেছে বাঙাল বুলিতে আর ডায়াসপোরিক বাংলায় । সুভাষ ঘোষ লিখেছে ক্রিপটিক ডিকশানে । কেবল বাসুদেব দাশগুপ্ত যে ধরণের গল্প লিখেছে তার সঙ্গে শাস্ত্রবিরোধিদের তুলনা করা যায় । আমি, ফালগুনী, অরুণেশ ঘোষ, অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার অনেক পরে ফিকশান লেখা আরম্ভ করি । জেব্রার মোটে দুটো সংখ্যা বেরিয়েছিল, শাস্ত্রবিরোধিদের বহু পত্রিকা আর বই প্রকাশিত হয়েছিল । 

সজ্জ্বল : হাংরি আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা গভীরতাসম্পন্ন ও শক্তিশালী  কবি কে বা কে কে? কার কার নাম করবেন ? 

মলয় : শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, ফালগুনী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, শম্ভু রক্ষিত । আমি এনাদের সবায়ের সম্পর্কে লিখেছি । শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতার মূল্যায়ন আমিই প্রথম করেছিলুম, কিন্তু উনি যতোদিন বেঁচেছিলেন আমাকে গালমন্দ করে গেছেন, এমনকী নিজের মেয়েকেও বলে গিয়েছিলেন যে উনি মারা যাবার পর ওনার মেয়ে যেন তা বজায় রাখেন । হয়তো ওনার নাতিও বড়ো হয়ে তা বজায় রাখবে ।

সজ্জ্বল : খুব স্পষ্ট এবং খোলাখুলিভাবে জানতে চাইছি মলয়দা , হাংরি আন্দোলনের ভাষাতেই জানতে চাইছি , জীবনের এই প্রান্তবেলায় দাঁড়িয়ে আপনি কী মনে করেন ? তরুণ হাংরি কবি মলয় রায়চৌধুরীর ” প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ” তদানীন্তন থেকে প্রবহমান বাংলা কবিতায় আদৌ কিছু কী ‘ছিঁড়তে’ পেরেছিল , বা পারল ? 

মলয় : এটা বাঁকবদলের কবিতা । অনেকে বুঝতে পারেনি ‘ছুতার’ শব্দটা কিসের দ্যোতক ! এই কবিতার প্রভাবে বাংলা কবিতার শব্দভাঁড়ারে অভূতপূর্ব সব বদল ঘটে গিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের শব্দভাঁড়ারকে বর্জন করার ফতোয়া ছিল কবিতাটা । দানিয়েলা কাপেলো আর শীতল চৌধুরী এই কবিতাটার বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন বাংলা কবিতায় কেমন প্রভাব ফেলেছে । দানিয়েলার বিশ্লেষণ পাবে অ্যাকাডেমিয়ার সাইটে । শীতল চৌধুরীর প্রবন্ধটা নেট সার্চ করলেই পাবে।

সজ্জ্বল দত্ত : আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ শয়তানের মুখ ‘ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে । কৃত্তিবাসের কর্ণধার যিনি ছিলেন তার সঙ্গে তখন আপনার সম্পর্কের রসায়ন যাইই থাক , পরবর্তীকালে তার গোটা জীবনের সাহিত্য কর্মকাণ্ড এবং কৃত্তিবাস পত্রিকা ও প্রকাশনীর সাহিত্যধারার ওপর বড় করে আলো ফেললে পরে কখনো কি আপনার মনে হয়নি যে আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি আপনার  আদর্শগত জায়গার একেবারে বিপরীতে অবস্থান করা কোনো প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ?

মলয় : কৃত্তিবাস তখনও মাঙ্কি পক্সে আক্রান্ত হয়নি । সুনীল তখনও পত্রিকাটা কৃত্তিবাসের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আনন্দ বাগচীর থেকে ছিনিয়ে নেননি । আনন্দবাজারে সুনীল ঢোকার পর কৃত্তিবাস পালটি খেয়ে যায় । আমার ‘রাহুকেতু’ আর ‘চাইবাসা আবিষ্কার’ উপন্যাস পড়লে ব্যাপারটা তোমার কাছে স্পষ্ট হবে । আমার স্কুলে পড়ার সময় থেকে সুনীল আমাদের পাটনার আর উত্তরপাড়ার বাড়িতে আসতেন । সুনীল যখন বেকার তখন দাদা কৃত্তিবাস চালাবার খরচ দিয়েছেন বেশ কয়েকবার। ‘সুনীলকে লেখা চিঠি’ বইতে পাবে । সুনীলের ‘একা এবং কয়েকজন’ দাদা ছাপিয়েছিলেন ‘সাহিত্য প্রকাশক’ নামে প্রকাশনার নাম দিয়ে। তাই বইটা কৃত্তিবাস থেকে বেরিয়েছিল বলে আমার অবস্হানের কোনো বদল ঘটেনি । সুনীল অবশ্য হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার পর আমার আর দাদার কাছে কবিতা চাননি ।

সজ্জ্বল : এটা কিন্তু আজ সর্বস্তরেরই সাহিত্যপাঠক বিদিত একটি সত্য যে হাংরি আন্দোলন তাৎক্ষণিক একটা হৈচৈ পাঠকমহলে তৈরী করতে সক্ষম হলেও শেষ পর্যন্ত এই সাহিত্যআন্দোলন কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েছিল এবং  সমাজমানসে দীর্ঘ কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি । এর কারণ কী বলে মনে করেন ? অন্ত:সারশূন্যতা ?

মলয় : তোমার বোধহয় জানা নেই যে এই আন্দোলন নিয়ে বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভারতীয় আর বিদেশি ভাষায় গবেষণা হয়েছে আর এখনও হচ্ছে । এখনও পিএইচডি আর এমফিল করছেন অনেকে । ইতালি থেকে দানিয়েলা কাপেলো এসে তথ্য সংগ্রহ করে হাংরি আন্দোলন নিয়ে ডক্টরেট করেছেন জার্মানি থেকে । ওনার গবেষণার বইটা ইংরেজিতে প্রকাশের তোড়জোড় চলছে । উনি ফালগুনী রায় সম্পর্কে বাংলায় যে প্রবন্ধ লিখেছিলেন সেটা আমি ফেসবুকে শেয়ার করেছি । সম্প্রতি  ইংরেজিতে পেঙ্গুইন র‌্যাণ্ডাম হাউস থেকে মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরীর লেখা বই বেরিয়েছে ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ নামে । রাহুল দাশগুপ্ত আর বৈদ্যনাথ মিশ্র দুজনে একটা ইংরেজি সংকলন প্রকাশ করেছেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের ছবি আঁকা নিয়ে জুলিয়েট রেনল্ডস ‘রোডস অ্যাক্রস দি আর্থ’ নামে একটা বই লিখেছেন ২০১৮ সালে । জনমানস বলতে তুমি বোধহয় কফিহাউসের আড্ডাবাজদের বোঝাতে চেয়েছো ।

সজ্জ্বল : ঠিক তা নয় । একটু আগেই এক প্রশ্নের উত্তরে আপনি বললেন “এখনকার পশ্চিমবাংলার দিকে তাকালে আমার বক্তব্যকে ভবিষ্যদ্বাণী বলে মনে হবে” । আপনার ওই বক্তব্যের পূর্ণ প্রতিফলন যদি আপনার কবিতা তথা সমগ্র হাংরিকবিতা হয়, তবে এখনকার পশ্চিমবাংলার পরিপ্রেক্ষিতে ‘Gungshalik school of poetry’ কে সরিয়ে ‘আমাকে তোমার গর্ভে আমারি শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও’ কিংবা ‘তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি পুণ্য বিছানায়’ –এর মতো লাইনের কবিতাধারা পুরোপুরি বা অংশতঃ কোনোভাবেই কি ধীরে ধীরে মেইনস্ট্রিম কবিতা হয়ে উঠতে পারতো না ? ঠিক যেমন ব্রিটেনে দীর্ঘদিনের রোম্যান্টিক কবিতাধারাকে ঠেলে সরিয়ে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এজরা পাউণ্ড , এলিয়ট , ইয়েটস্ – দের modern movement কবিতাধারার মেইনস্ট্রিম হয়ে উঠতে পেরেছিল , colonial literature ধারাকে পরবর্তীতে ঠেলে সরিয়ে আফ্রিকায় চিনুয়া আচেবে বা যুক্তরাষ্ট্র ও লাতিন আমেরিকায় সলমন রুশদি ও গার্সিয়া মার্কেজরা তাদের post colonial literary movement কে অনেকখানি মেইনস্ট্রিম করে যেতে পেরেছিল ? … জনমানসে প্রভাব বলতে হাংরি সম্পর্কে এটাই জিজ্ঞাস্য ।

মলয় : কবিতার মেইনস্ট্রিম সরকার আর অকাদেমির সমর্থন ছাড়া হয় না । এখন কবিতার মেইনস্ট্রিম মানে চটিচাটার দল । তবে, তার বাইরে আমাদের প্রভাব লক্ষণীয়, অন্তত ফেসবুক আর ব্লগজিনগুলোতে নজরে পড়ে । ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে আমাদের লিফলেট আর লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্যের তুলনা করা উচিত নয় । আমার তো প্রকাশকই জোটে না । গাঙচিল নামে এক প্রকাশনার কর্ণধার বললেন, “আপনার বই কেন ছাপবো ? আপনার বই তো বুদ্ধদেব গুহর মতন বিকোবে না” । মেইনস্ট্রিম ফিকশান হতে হলে, যে বিদেশিদের নাম তুমি করলে, বড়ো প্রকাশনা দরকার, অনুবাদক দরকার, রিভিউকার দরকার । হাংরি আন্দোলনের কারোরই সেসব জোটেনি । বাংলা থেকে ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ না হলে ওনাদের মতন নজরে পড়া অসম্ভব । ইংরেজিতে অনুবাদের পরও রিভিউকারদের নজরে পড়া দরকার, নেটওয়র্কিঙ দরকার । শঙ্কর, সুনীল প্রমুখের বই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে, কিন্তু বিদেশে আলোচিত হয়নি । 

সজ্জ্বল : একবিংশ শতকের লেখক-কবিদের উপর হাংরি প্রভাব কতটা পড়েছে বলে আপনি মনে করেন?

মলয় : এটা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । এসব গবেষকরা বলবেন ।

সজ্জ্বল : ঠিক দু’বছর আগে হাংরি পরবর্তী বাংলা কবিতার আর এক আন্দোলন ” শতজল ঝর্ণার ধ্বনি “র অন্যতম প্রধান মুখ কবি দেবদাস আচার্য এই বারাকপুর স্টেশন পত্রিকাতেই সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছিলেন ” প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নয় , সঠিক শব্দটা বোধহয় হওয়া উচিত অপ্রাতিষ্ঠানিক ” । আপনি এই দুই শব্দের মধ্যে কোনটা পছন্দ করবেন? 

মলয় : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । উনি বোধহয় প্রতিষ্ঠান বলতে সংবাদপত্রের কথা বলতে চেয়েছেন । প্রতিষ্ঠান বলতে রাজনৈতিক দলগুলোকে, অর্থনৈতিক কঙগ্লোমারেটদেরও বোঝায় । আমি ফেসবুকে এই পোস্টটা দিয়েছিলুম, দেখেছো কিনা জানি না : “গৃহবধূর চটি মারার সাবাশি বিষয়ক: –সবচেয়ে চুতিয়া টাইপের নিরক্ষর হল রাজনৈতিকভাবে  অশিক্ষিতরা । তারা শোনে না, কথা বলে না বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে না। তারা জীবনের দাম জানে না , বাজারে জিনিসপত্রের দাম কেন বাড়ছে জানে না, কারা বাড়াচ্ছে জানে না । আলু-পটলের দাম, মাছের, আটার দাম, ভাড়া, জুতো, ওষুধের দাম, সবই নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। রাজনৈতিক নিরক্ষর  লোকগুলো এতটাই বোকা যে তারা গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলে যে তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে। মূর্খরা জানে না যে, তাদের রাজনৈতিক অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয় পতিতা, পরিত্যক্ত সন্তান আর সর্বাপেক্ষা জঘন্য রাজনৈতিক চোর, রাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের কোটিপতি দোস্ত।” বিরোধিতা না করলে দেশটা হিন্দুরাষ্ট্র নামের ডিকটেটরশিপে পরিণত হবে ।

সজ্জ্বল : আপনার সাহিত্য জীবনের প্রায় গোটাটাই বাংলার বাইরে কেটেছে। ২০১৩ সাল নাগাদ একবার কোলকাতায় এসে কিছুদিন এখানে থাকার চেষ্টা করেও অবশেষে ফিরে গিয়েছেন। সাহিত্য জগতে আজীবন নিঃসঙ্গতা একাকীত্ব আপনাকে কোথাও হতাশ করে? নাকি তা শাপে বর হয়েছে?

মলয় : না । কলকাতায় যতোদিন পিসেমশায় ছিলেন ততোদিন মাঝে-মাঝে গেছি । পিসেমশায় আত্মহত্যা করার পর পিসিমা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোতরঙ চলে গেলেন । কলকাতায় তো কোনও আত্মীয় স্বজন ছিল না তাই আদিবাড়ি উত্তরপাড়ার জমিদারি খণ্ডহরে গিয়ে থাকতে হতো। উত্তরপাড়ায় ইলেকট্রিসিটি আর জলের কল ছিল না, ঠাকুমার হবিষ্যি খেতে হতো, নয়তো মুড়ি-মুড়কি, সেসময়ে খাবার হোটেল ছিল না উত্তরপাড়ায় । ১৯৮৮ সালে নাকতলায় একটা ফ্ল্যাট কেনার পর নিয়মিত থেকেছি । ১৯৯৫ সালে কলকাতা অফিসে বিভাগীয় আধিকারিক হয়ে গিয়েছিলুম । ওই সময়েই দাদা হাওয়া-৪৯ পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করেন । ১৯৮৮ এর আগে বারুইপুরে উত্তম দাশের বাড়িতে গিয়ে থাকতুম । ১৯৮৫ নাগাদ উত্তম আমার বেশ কয়েকটা বই প্রকাশ করেছিলেন । আমি আর উত্তম সন্ধ্যাবেলায় কেদার ভাদুড়ির ঘরে মদ খেয়ে নাচার আড্ডা জমাতুম । ওদের কাজের মাসি খুব ভালো মাছ রাঁধতে পারতেন । আসলে আমি সাহিত্যসভা বা কফিহাউসে যাতায়াত করিনি বলে তোমার মনে হচ্ছে কলকাতায় থাকিনি । কলকাতায় চাকরি করার সময়ে পুরো পশ্চিমবঙ্গে চষে ফেলেছিলুম । নামগন্ধ আর নখদন্ত উপন্যাসে সেসব অভিজ্ঞতা পাবে । নামগন্ধ উপন্যাসে আলুচাষের রাজনীতি আর নখদন্ত উপন্যাসে পাট চাষের রাজনীতি নিয়ে লিখেছি ।

সজ্জ্বল : হাংরি লেখালেখির বাইরে যে বাংলা সাহিত্য সেখানে সাহিত্যিক হিসেবে আপনার পছন্দের মানুষ কারা?

মলয় : অনেক, অনেক, অনেক । বিশেষ করে তরুণদের লেখা আমার ভালো লাগে ।

সজ্জ্বল : একজন বাংলা সাহিত্যপাঠক মলয় রায়চৌধুরীকে কীভাবে মনে রাখবে বলে আপনি মনে করেন ?

মলয় : মনে রাখার দরকার তো নেই ! দুশো-তিনশো বছর আগের কবিদের অনেককেই কেউ মনে রাখেনি, অনুসন্ধানী গবেষকরা ছাড়া ।

সজ্জ্বল : সম্প্রতি জেমস ওয়েবের টেলিস্কোপ আমাদের বিশ্বের সৃষ্টি রহস্য খানিকটা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। এমত পরিস্থিতিতে মলয় রায়চৌধুরীর ঈশ্বরভাবনা জানতে ইচ্ছে করে। 

মলয় : হিন্দুধর্মে ঈশ্বর বলে কিছু নেই । ওটা এসেছে ইসলাম আর খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে আর ব্রাহ্মরা তাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। হিন্দুদের কাছে পৃথিবীর সব কিছুই পূজ্য । তাই আমাদের আছেন দেবী-দেবতারা । আমি কোনো কালে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিনি, গোঁড়া সাবর্ণ রায়চৌধুরী ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্য হয়েও । জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আমাদের বিস্ময় আর জ্ঞানের বিস্তার ঘটাচ্ছে ; ঈশ্বরের অস্তিত্বের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই ।

সজ্জ্বল : মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আপনার চেতনায় মৃত্যু কীভাবে ধরা দেয়?

মলয় : মৃত্যু সম্পর্কে ভাবার দরকার নেই । বরং অসুখে পড়লে হাসপাতালের আর দাহ করার খরচ কেমন করে মেটানো হবে সেটাই চিন্তার। 

সজ্জ্বল : দীর্ঘ বিরাশি / তিরাশি বছরের ফেলে আসা জীবনের দিকে ফিরে তাকালে কী মনে হয় আজ? কোনো অপ্রাপ্তির কথা মনে হয়? জীবনকে বদলে নিতে ইচ্ছে করে? 

মলয় : হ্যাঁ। বাবাকে মুম্বাই নিয়ে আসিনি বলে রিগ্রেট হয় । এখানে ওনার ভালো চিকিৎসা করাতে পারতুম । ইন ফ্যাক্ট, আমরা বুড়ো-বুড়ি মুম্বাই চলে এসেছি চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধার জন্য ।

সজ্জ্বল : এই প্রজন্মের নবীন কবিকে পোড় খাওয়া বরিষ্ট কবি মলয় রায়চৌধুরী কী উপদেশ দিতে চাইবেন?

মলয় : বিন্দাস লিখে যাও । কে কী বলছে ভাবার দরকার নেই ।

সজ্জ্বল : ভালো থাকবেন মলয় দা। পত্রিকার পক্ষ থেকে আরও একবার ধন্যবাদ এবং নমস্কার জানাই।

মলয় : তুমিও ভালো থেকো, সুস্হ থেকো আর আমার অন্তত একটা উপন্যাস পোড়ো, বন্ধুদের পড়িও । তোমরা তো আমার কোনো বই পড়োনি বলে মনে হচ্ছে। তোমাদের পত্রিকাও দীর্ঘ জীবন লাভ করুক।